মার্ক টোয়েন (Mark Twain)

ধারাবাহিক (পর্ব ১-৪২)

-তিমুর

timursblog@yahoo.com

© সংরক্ষিত

 পর্ব (১-১০)

 পর্ব (১-০)

পর্ব (২১-৩০)

 

র্ব-৩১

৮৯৩ সালের বসন্তকালে কাজ ফেলে আমেরিকায় যেতে হলো তাঁকে ওয়েস্টার অ্যান্ড কোম্পানি একেবারে শেষ অবস্থায় পৌঁছেছে কোনো অবস্থাতেই তাকে বাঁচানো সম্ভব নয় দুই লাখ ষাট হাজার ডলার দেনা হয়েছে তাঁর দৈনিক এক ডলার ভাড়ার একটা সস্তা হোটেলে থাকতেন তিনি এত খারাপ অবস্থায় এর আগে তিনি কখনো পড়েননি এমন কী নেভাডায় থাকার সময়েও কেবল নিজের কথাই ভাবতে হতো তাঁকে আটান্ন বছর বয়সে পরিবার সহ দেউলিয়া হবার বেইজ্জতির জ্বালাই অন্য রকম

এমন সময় একদিন তেলখনির মালিক হেনরি রজার্স দেখা করতে এলেন টাকা পয়সার কথা কিছূই তাঁকে বলেননি মার্ক টোয়েন হোটেলের রেস্তোঁরা বসে খেতে খেতে আগের মতোই ঠাট্টা করতে লাগলেন কিন্তু ব্যাবসায়ী রজার্স মার্ক টোয়েনের আর্থক অবস্থা জানতে উৎসুক ছিলেন

'
মি. ক্লিমেন্স, আপনি হয়তো জানেন না কিন্তু আনেক বছর আগে সান ফ্রানসিস্কোতে, হাওয়াই দ্বীপোএর উপর আপনার লেকচার শুনে দারুন মজা পেয়েছিলাম আপনার জন্য কিছু করতে পারলে খুশি হবো '

অতএবে মার্ক টোয়েন তাঁর সমস্ত ব্যবাসায়িক কাগজপত্র মি রজার্সকে দেখতে দিলেন রজার্স বললেন টাইপসেটিং মেশিনটার সফল হওয়ার বেশ একটা সম্ভাবনা আছে সে জন্য তিনি একটা মোটা অংক ধার দিলেন টাকা পেয়ে আবার আগের মেজাজে ফিরে গেলেন মার্ক টোয়েন তবে ওয়েস্টার অ্যান্ড কোম্পানিকে আর বাঁচানো সম্ভব হলো না

কথা ছিল টাইপ সেটিং মেশিনটা সফল না হলে টাকা ফেরত দিত হবে না আসলে ধনকুবের মি. রজার মার্ক টোয়েন দেউলিয়াত্বের হাত থেকে বাঁচানোরজন্য্ই এমন করেছিলেন ভাবলে ভুল হবে না বিশেষ জিনিসটা যখন শেষমেষ কোনো কাজের না বলে প্রতিপন্ন হলো তখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে প্যারিসে চলে গেলেন মার্ক টোয়েন এখন এটা নিয়ে ভাববার আর কোনো প্রয়োজন নেই

ব্যার্থ টাইপ সেটিং মেশিনটা এখন সিবলি কলেজ অভ এঞ্জিনিয়ারিং রাখা আছে ডিসপ্লেতে মেশিনটাকে বলা হয় ওজন আয়তন অনুপাতে এটা পৃথিবীর সবচেয়ে খরচবহুল যন্ত্র একবার এক লোক যন্ত্রপাতির প্যাটেন্টের উপর বই লিখে মার্ক টোয়েনের কাছে ভুমিকা লেখা জন্য চিঠি লিখেছিলেন চিঠির জবাবে মার্ক টোয়েন লেখেন,

"DEAR SIR,--I have, as you say, been interested in patents and patentees. If your book tells how to exterminate inventors, send me nine editions. Send them by express.

"Very truly yours,

"S. L. CLEMENS."

এই সময়ে পুরনো বইয়ের রয়্যাল্টি ছাড়া মার্ক টোয়েনের আর কোনো রোজগার ছিল না এবং সেটাও খুব বেশি ছিল না সুতরাং হিসেব করে খরচ করতে হতো আশ্চযের্র বিষয় সময় মার্ক টোয়েন আশ্চর্য ভাল মুডে ছিলেন এবং পরিবারের লোকেরাও দুঃখে ছিলেন বলা যাবে না প্রায় প্রতিরাতেই ক্লিমেন্স সারাদিনে কী লিখেছেন সেটা পড়ে শোনাতেন একরাতে সুজি তার ডায়েরিতে লেখলো , 'আজ রাতে জোয়ান অভ আর্ককে পুড়িয়ে মারা হয়েছে !' অর্থাৎ জোয়ানের অভ আকের্র উপর লেখা বইটা শেষ হয়েছে

সুজি ক্লিমেন্স নিজেও ভালই লেখত অন্তত যে সব টুকরো লেখা পাওয়া গেছে তা থেকে এরকম অনুমান করাটা খুব স্বাভাবিক যে যাই হোক, জোয়ান অভ আকের্র উপর বইটা ধারাবাহিকভাবে হার্পার্স ম্যাগাজিনে ছাপা হতে লাগল লেখকের কোনো নাম দেয়া ছিল না কিন্তু পাঠকরা ঠিক ধরে ফেলল মার্ক টোয়েনের হাত শুধু মার্ক টোয়েনই নকল করতে পারেন!

৮৯৫ সালের বসন্তে মার্ক টোয়েনে তাঁর হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধারে নতুন পরিকল্পনা ফাঁদলেন লেকচার দিতে খুব ভাল না লাগলেও গোটা পৃথিবীতে তিনি টাকার বিনিময়ে (এখন আর বিন পয়সায় গলাবাজি পোষাবে না টোয়েনের) বক্তৃতা দিয়ে বেড়াবেন

র্ব-৩২

      

ওয়ার্ল্ড ট্যুরটা অত্যন্ত সফল ভাবে হলো আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভারত, সিংহল, দক্ষিন আফ্রিকা যেখানেই গেছেন অত্যন্ত উচ্ছসিত সমাদর পেয়েছেন তিনি সমস্ত মানুষের কাছ থেকে কলকাতা সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য 'এখানকার গরমে একটা পিতলের নব গলে যাবে (!) '

কিন্তু গড়ের মাঠে অক্টারলোনি মনুমেন্ট তাঁকে দারুন আকর্ষণ করেছিল এই সম্স্ত ভ্রমনের উপর তিনি 'চেজিং দ্যা ইকুয়েটর' বইটা লিখতে শুরু করে ভাবলেন, এবার সব ধার দেনা শোধ দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করা যাবে সব

টাকা পয়সা যা পাচ্ছিলেন সব রজার্স কে পাঠাচ্ছিলেন, টাকার অংকটা এতোই বড় হচ্ছিলো যে মার্ক টোয়েন ভাবছিলেন এতো দিনে দেনাদারের করাল গ্রাস থেকে তিনি মুক্তি পাবেন, পৃথিবীতে তিনি মাথা উঁচু করে চলতে পারবেন যখন দক্ষিন আফ্রিকা থেকে জাহাজে উঠলেন ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে তখন খুব ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন টোয়েন প্রায় এক বছরের সফর শেষ পর্যায়, আমেরিকাতে সুজি আর জিনকে টেলিগ্রাম করা হলো তারা যেন লন্ডনে এসে শীতকালটা কাটিয়ে যায়

জুনের শেষ দিন মার্ক টোয়েনের জাহাজ এসে ইংল্যান্ডে পৌঁছাল সুজি আর জিন তাদের পরিচারিকা ক্যাটি লিয়ারিকে নিয়ে অগাস্টের বারো তারিখে পৌঁছানোর কথা বারো তারিখে সুজি এলো না, এলো একটা চিঠি চিঠিতে লেখা, সুজির শরীর জাহাজে চড়ার মতো ভাল নেই, সুজি পরে আসবে লিভি ক্লিমেন্স, ক্লারাকে নিয়ে আমেরিকায় উদ্দেশ্যে জাহাজে চাপলেন পনেরোই অগাস্ট মার্ক টোয়েন ডায়েরিতে লিখলেন, "That was the 15th of August, 1896. Three days later, when my wife and Clara were about half-way across the ocean, I was standing in our dining-room, thinking of nothing in particular, when a cablegram was put into my hand. It said, 'Susy was peacefully released today.'"

মার্ক টোয়েনের জীবনে যে কয়টা ট্র্যাজেডি ঘটেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড়গুলোর একটা হচ্ছে বিদেশে থাকার সময় বড় মেয়ে সুজি ক্লিমেন্সের মৃত্যু প্রায় এক বছর মেয়েকে দেখেন নি তিনি, এবং আর কোনো দিন দেখার উপায় রইলো না

কোয়্যারি ফার্মে ভালই ছিল সুজি মাঝখানে সে হার্টফোর্ডে বেড়াতে এসেছিল জর্জ ডাডলি ওয়ার্নারের বাড়িতে সেখানেই অসুখ বাঁধিয়ে ফেলে সে কয়েকদিন পরে বোঝা যায় রোগটা ছিল মেনিনজাইটিস সেই
৮৯৬ সালে অ্যান্টিবায়োটিক ছিল না যে এর চিকিৎসা করা যাবে অনেক দিন আগে মারা যাওয়া ছোট্ট ভাইটার পাশে কবর দেয়া হলো তাকে সুদূর অস্ট্রেলিয়াতে দেখা একটা কবরের ফলকে রবার্ট রিচার্ডসনের এই কয়টা লাইন লেখা হলো,

Warm summer sun, shine kindly here;
Warm southern wind, blow softly here;
Green sod above, lie light, lie light!--
Good night, dear heart, good night, good night.


ক্লারা আর জিনকে নিয়ে লিভি ক্লিমেন্স লন্ডনে ফিরে এলেন এবং শোকগ্রস্ত পরিবার লন্ডনে টেডওয়ার্থে একেবারে কাউকে না জানিয়ে বাস করতে লাগল বাজারে এরকম গুজব শোনা যাচ্ছিল মার্ক টোয়েনের পারিবার তাঁকে ত্যাগ করেছে এবং প্রৌঢ়, অসুস্থ টোয়েন ঋণ শোধের জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করে চলেছেন আরেকটা বিদঘুটে গুজব ছিল মার্ক টোয়েন মারা গেছেন আসলে লন্ডনে অল্প কিছু শুভানুধ্যায়ী কেবল জানতেন মার্ক টোয়েন কোথায় আছেন একজন ছিলেন স্যামের দূরসম্পর্কীয় জ্ঞাতি ভাই . জেমস ক্লিমেন্স

একজন রিপোর্টার গোয়েন্দার মত খুঁজে বের করে ফেলল মার্ক টোয়েনের ডেরা গৃহকর্তা সরাসরি জিগ্যেস করল বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁর কী বলার আছে?

টেনে টেনে (আর সব দক্ষিনীদের মতোই টেনে কথা বলতেন মার্ক টোয়েন) কিছুটা নাকী গলায় মন্তব্য করলেন মার্ক টোয়েন, 'আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, আমার মৃত্যুর খবরটা খানিকটা অতিরঞ্জিত '

আসলে হিউমার ছিল ক্লিমেন্সের মজ্জাগত আসলে লেখক হিসেবে যতটা না খ্যাত ছিলেন প্রায় ততটাই লোকে তাঁকে চেনে মজাদার কথা বলার জন্য ইন্টারনেটে 'মার্ক টোয়েন কোটেশন' ঘাঁটলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে

র্ব-৩৩

ততো দিনে আরো দুটো বই বেরিয়েছে তাঁর একটা 'জোয়ান অভ আর্ক' অন্যটা টম সয়্যারের নতুন বই 'টম সয়্যার অ্যাব্রড' আর 'টম স্য়্যার ডিটেকটিভ' নামে ছোট দুটো উপন্যাসের সংকলন তিনটাই পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছিল 'জোয়ান অভ আর্ক' মার্ক টোয়েনের সবচেয়ে উঁচু কাজ মার্ক টোয়েন যতদিন বেঁচে ছিলেন জোয়ান অভ আর্ককেই সবচেয়ে সেরা বই বলে মনে করতেন

'
আমি মনে করি 'জোয়ান অভ আর্ক' আমার সেরা বই এটা লিখে আমি অন্য সব বইয়ের সাতগুন বেশী আনন্দ পেয়েছি লিখতে বারো বছর প্রস্তুতি সহ দু'বছর লেগেছে বাকি গুলোর পিছনে কোনো প্রস্তুতিই নিতে হয় নি '

সাধারন মানুষ আবশ্য মার্ক টোয়েনের সাথে শুরুতে একমত হয়নি শুরুতে এর বিক্রি ছিল খুব কম তবে আস্তে আস্তে জোয়ানের বিক্রি বেড়ে যেতে থাকে সত্যি বলতে কী প্রতি বছরই এটার বিক্রি বাড়তে থাকে এবং মার্ক টোয়েনের অন্য বেস্ট সেলারগুলোর সাথে জায়গা করে নেয় টম আর হাকের নতুন গল্পগুলোও চলেছিল ভাল, যদিও আগের বইগুলোর তুলনায় গল্পগুলো ছিল ছোট

সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন হ্রদের ধারে ভিলা বুলেগে দিনে পাঁচ ফ্রাংক ভাড়া দিয়ে থাকছিলেন তাঁরা ঠিক সেসময়ে মার্ক টোয়েন ঠিক কাজের মুডে ছিলেন না আর 'চেজিং দ্য ইকুয়েটর' বইটার প্রুফ দেখতে হচছইল নিয়ম করে হারপার্স ম্যাগাজিন থেকে লেখাটা এখন বই আকারে বের হলো

ভিলাটার উল্টো দিকে, হ্রদের উল্টোপারে একটা গাছে ঢাকা জায়গায় বসতেন ইতনি প্রায়ই ঊনিশ বছর আগে টুইচেল আর তিনি এখানে এসেছিলেন সেখানে একটা জার্মান ফলক শোভা পাচ্ছে এখন, 'মার্ক টোয়েনের বিশ্রাম নেয়ার জায়গা'

শরতকালে ভিয়েনার হোটেল মেট্রোপোলে উঠলেন তাঁরা মিসেস ক্লিমেন্স ভাবলেন যাই হোক মেয়েদের সামাজিকতার একটা সুযোগ থাকা দরকার ভিয়েনার সাহিত্য বোদ্ধা মহলে বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ লোক হয়ে উঠলেন মার্ক টোয়েন সমস্ত ক্লাব থেকে ডাক আসতে লাগল

ঠিক সেসময়ে আবার মার্ক টোয়েন প্রচুর লিখতে আরম্ভ করেছেন ব্যাপার হচ্ছে ঋণ শোধ করে দেয়ার ফলে নিজেকে অনেক নির্ভার ভাবছিলেন তিনি সমস্ত পাই-পয়সা বাঁচিয়ে পাওনাদারদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি
৮৯৮ সালের জানুয়ারী মাসে ক্লিমেন্স সমস্ত ঋণ শোধ করে দেয়ার মতো টাকা জোগাড় করে ফেলেছেন সমস্ত ঋণ শোধ দেয়অর পরেও তেরো হাজার ডলার ছিল তাঁর হাতে সে মাসে 'দ্য ম্যান হু করাপ্টেড হ্যাডলিবার্গ' সময়েই লেখা

র্ব ৩৪

অনেকে ভাবতে পারে যে এবারে মার্ক টোয়েনের আক্কেল হয়েছে এবারে আর কোনো বিদঘুটে প্রজেক্টে পয়সা খাটাবেন না তিনি কিন্তু পরের মাসেই তিনি এক অস্ট্রিয়ান কার্পেট প্রস্তুত কারকের কার্পেট বোনার যন্ত্রে লগ্নি করার কথা ভাবতে লাগলেন কিন্তু এই 'যাদুর কার্পেট' প্রজেক্ট থেকে স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের হেনরি রজার্স টোয়েনকে নিরস্ত করলেন

প্রচুর ম্যাগাজিন আর্টিকল লিখেছেন তিনি সময় এর বেশ কিছু পরে 'ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স' নামে সংকলিত হয়েছে কিন্তু আমরা একধরনের তিক্ততা দেখতে পাই টোয়েনের লেখার মধ্যে হতে পারে হারানো সময়ের জন্য মনস্তাপ থেকেই হয়েছিল এটা

প্রাব নয় বছর ধরে ইউরোপে থাকছেন তাঁরা এমন সময় বাহাত্তর বছর বয়সে মার্ক টোয়েনের বড়ভাই ওরাইওন ক্লিমেন্সের মৃত্যু হলো কেওকুকে কোনো অসুখ বিসুখ ছিল না ওরাইওনের, এক সকালে মৃত্যু এসে স্রেফ কড়া নেড়ে ছিল তাঁর দুয়ারে

মার্ক টোয়েন এসময়ে ভিয়েনার হোটেল ক্রানৎসে থাকতেন তাঁর স্যুইটটাকে বলা হতো 'সেকেন্ড এমব্যাসি' কারন তখন অস্ট্রিয়ার (তখন অস্ট্রো-হাঙ্গারিয়ান সাম্রাজ্যে ) সবচেয়ে পরিচিত খ্যাতিমান আমেরিকান ছিলেন টোয়েন

কাজে অকাজে কারনে -অকারনে লোকে দেখা করতে আসতো টোয়েনের সাথে যদিও নিজে ধুমপান করতেন তাহলেও দশ হাজার ডলারের বিনিময়ে একটা তামাকের বিজ্ঞাপনে তাঁর নাম ব্যাবহার করতে দিতে আপত্তি জানালেন তিনি আরেকবার দশটা লেকচারের বিনিময় দশ হাজার ডলার প্রস্তাবও প্রত্যাখান করলেন, যদিও টাকার খুব দরকার ছিল তখন এরকম ভাবে টাকা কামালে আত্মসন্মান বিক্রি হয় বলেই ধারনা ছিল তাঁর

১৮৯৯ সালের গ্রীস্ম কালে ভিয়েনা ছাড়লেন তাঁরা জিনের অসুখের কারনে গ্রীস্মকালটা সুইডেনে যাত্রাবিরতি করলেন তারপরে শীত কাটানোর জন্য ৩০, ওয়েলিং কোর্ট লন্ডনে, যাত্রা বিরতি করলেন ক্লিমেন্স পরিবার পরের গ্রীস্মে লন্ডনের ঠিক বাইরে ডলিস হিলে উঠলেন, যেখানে প্রধান মন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন থাকতেন অনেক সময় জায়গাটার এখনকার নাম গ্ল্যাডস্টোন পার্ক

অক্টোবরের তারিখ ১৯০০ সালে, পঁয়ষট্টি বছর বয়সে আমেরিকায় ফিরে এলেন মার্ক টোয়েন
লন্ডন, ভিয়েনার থেকে নিউ ইয়র্কের পত্রিকাগুলো মার্ক টোয়েনকে অভিনন্দনে কম যায়নি মার্ক টোয়েনের বিশাল ঋণ সেসব শোধের গল্প এখন লোকের মুখে মুখে লোকে তাঁকে স্যার ওয়াল্টার স্কটের সাথে তুলনা করছে

কারন স্কটও লিখে বিশাল ঋণ শোধ দিয়েছিলেন ক্লাব আর সমিতি গুলো হামলে পড়ল বক্তৃতা দেয়ার জন্য কাগজগুলো এসে বলল প্রতিটা শব্দ এক ডলার এই হারে তাঁকে পারিশ্রমিক দেবে তারা কিন্তু তেমন সাড়া দিলেন না টোয়েন

লেকচারে রুচি ছিল না আর তাঁর মাঝে মাঝে এখানে সেখানে এক আধটা লেকচার দিতেন কোনো ডিনার পার্টিতে অল্প কিছু পত্রিকাতে লিখতেন হার্পার ব্রাদার্স তাঁর সমস্ত লেখা একত্রে ছাপার বন্দোবস্ত করছে নিরিবিলি থাকতেই থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন ক্লিমেন্স

মানুষ এখন মার্ক টোয়েনের কথার মধ্যে একটা অন্য সিরিয়াস সুর শুনতে পাচ্ছিল হ্যাঁ, এখনো মাঝে মাঝে হাসাতে পারতেন তিনি কিন্তু আগের চেয়ে অনেক সিরিয়াস হচ্ছিলেন তিনি কথার মধ্যে তাঁর অন্যতম বিষয় ছিল দেশপ্রেম তবে সেটা ঠিক অন্য লোকের দেশপ্রেম নয়

দেশকে যদি ভালবাসতে হয়, তবে পতাকাকে পবিত্র রাখতে হবে সবাই যে কথা বলে সেটাই সঠিক মেনে নিলে দেশপ্রেমের অর্থ থাকে না 'রাজতন্ত্রেও দেশপ্রেম নিয়ে কথা বলা হয় আমাদের দেশপ্রেম কী সেরকম হবে?' "মাই কান্ট্রি রাইট অর রং" ধাঁচের অন্ধ দেশপ্রেমে অরুচি ছিল টোয়েনের

র্ব-৩৫

মার্ক টোয়েনে ইচ্ছা ছিল আবার হার্টফোর্ডে গিয়ে পুরনো বাড়িটায় ওঠা কিন্তু সুজির মৃত্য সব পাল্টে দিল আর এখানে থাকলে আগের মতো লাগবে না বুঝতে পারলেন টোয়েন শেষবারের মতো ঘরগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিউ ইয়র্কে ফিরে গেলেন তাঁরা

গ্রীস্মকালে সারানাক হ্রদে, একটা লগ ক্যাবিনে থাকতেন তাঁরা ক্যাবিনটাকে টোয়েন তাঁর 'গুহা' বলতেন এখানে বসেই তিনি ' ডাবল ব্যারেল্ড ডিটেকটিভ স্টোরি' লিখেছেন

নিউ ইয়র্কে না ফিরে হাডসন নদীর উপর রিভারডেলে একটা বাড়ি ভাড়া নিলেন টোয়েন জায়গাটা ছিল অ্যাপলটন প্লেস সম্ভব হলে জায়গাটা কিনে নিতেন ক্লিমেন্স, কিন্তু টাকা ছিল না পরের বছর ইউনিভার্সিটি অভ মিসৌরি থেকে সন্মানসুচক এল এল ডি ডিগ্রি পেলেন তিনি ডিগ্রি নেয়ার উদ্দেশ্যে সেইন্ট লুইতে রওয়ানা হলেন তিনি

পুরনো ওস্তাদ হোরেস বিক্সবির সাথে দেখা হলো পঁয়তাল্লিশ বছর আগের মতোই কর্মঠ আছেন তাঁকে দেখে মার্ক টোয়েন বললেন 'আমি বুড়ো হয়ে গেছি, কিন্তু আপনি এখনো পঁয়ত্রিশ বছরে আছেন (!)'

পাইলটস অ্যাসোসিয়েশনে হৈ হৈ করে মার্ক টোয়েনকে সংবর্ধনা দেয়া হলো তারপরে আবার হ্যানিবালের উদ্দেশ্যে ট্রেনে চাপলেন তিনি

ছোটবেলার মেয়ে বন্ধু লরা হকিন্সের (বেকি থ্যাচার!) সাথে দেখা হলো তিনি এখন মিসেস ফ্রেজার বিধবা জনি ব্রিগস প্রৌঢ় এখন জন রোবার্ড আর অন্যান্য ছোটবেলার সঙ্গীদের সাথে গিয়ে হিল স্ট্রিটের বাড়িতে গেলেন দরজার সামনে ফটোগ্রাফাররা ভীড় জমিয়েছিল

'
বাড়িটা খুব ছোট মনে হচ্ছে আমার কাছে কিন্তু একজন বাচ্চাছেলের কাছে সবকিছুই বড় বড় ঠেকে আজ থেকে দশ বছর পরে যদি ফিরে আসি তাহলে দেখবো বাড়িটা পাখির বাসা হয়ে গেছে !'

জনি ব্রিগসকে নিয়ে লাভার্স লিপ আর হলিডে হিল ঘুরে বেড়ালেন 'হাকলবেরি ফিন' মানে টম ব্ল্যাংকেনশিপের সাথে দেখা হলো না জাজ ব্ল্যাংকেনশিপ আসতে পারেননি তাঁরা দুজন মানত 'টম সয়্যার' আর 'জো হার্পার' মিসিসিপি নদীর কুলুকুলু স্রোতের দিকে তাকিয়ে রইলেন পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সময় কেটে গেছে তাঁদের সেই সোনালী বন্ধুত্বময় শৈশবের পর!

এরপরে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা স্টেশনে ফুল হাতে মানুষের ঢল নেমেছে প্ল্যাটফর্মে দু'চার কথা বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু মানুষের হট্টগোলে কেউ কিছু শুনতে পেল না তারপরে আবারো সেইন্ট লুই সেইন্ট লুই হার্বারের নতুন নামকরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আগে এর নাম ছিল শুধু 'সেইন্ট লুই,' এবার বন্দরের নতুন নাম হলো 'মার্ক টোয়েন হার্বার' (!)

রিভারডেলের বাড়িতে জীবনটা খুব চমৎকারভাবে শুরু হলেও মেঘ ঘনিয়ে এল সেখানে লিভি অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং চলাফেরা প্রায় বন্ধ হয়ে ঘরে বন্দী হলেন তিনি বাড়ির প্রাণকেন্দ্র যে অলিভিয়া ক্লিমেন্স ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই ডায়েরিতে লিখলেন,শীতের সময় খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন লিভি কিন্তু সে অল্প সময়ের জন্য

"Our dear prisoner is where she is through overwork--day and night devotion to the children and me. We did not know how to value it. We know now."

তেত্রিশতম বিবাহবার্ষিকীর দিন ২রা ফেব্রুয়ারী, ১৯০৩ সালে লিভির ঘরে পাঁচ মিনিট কাটানোর অনুমতি পেলেন টোয়েন দশ বছর আগে ফ্লোরেন্স শহরে থাকার কথা বললেন লিভি তিনি বললেন আবার ফ্লোরেন্স যেতে পারলে ভাল হয়ে উঠবেন তিনি ডাক্তারদের অনুমতি পাওয়া গেল জুনের দিকে তিনি কোয়্যারি ফার্মে যাবার মতো এতোটা সু্স্থ হয়ে উঠলেন

র্ব-৩৬

এলমিরাতেই মার্ক টোয়েন তাঁর অষ্টভুজ আকৃতির স্টাডিতে তাঁর একটা গল্প লিখলেন ' ডগস টেল ' ঊনত্রিশ বছর আগে টম সয়্যার লিখেছিলেন তিনি ঘরে ঘরে এটাই হবে তাঁর শেষ গল্প

মার্ক টোয়েন বুঝতে পারছিলেন, এবার ইউরোপে গেলে হয়তো পুরো জীবনের জন্যই যেতে হবে অক্টোবরের শুরুতে ডায়েরিতে লিখলেন, 'আজ সুজির কবরে ফুল দিলাম, সম্ভবত শেষবারের মতো '

অক্টোবরের ২৪ তারিখে জাহাজে উঠলেন নেপলস আর জেনোয়া হয়ে ফ্লোরেন্সের কাছে ভিলা রিয়ালে দে কোয়ার্তো তে উঠলেন তাঁরা

বাড়িটা দেখতে খুব বিষন্ন দেখতে ছিল, পুরনো বিবর্ণ দেয়াল, জঙ্গল হয়ে ওঠা সাইপ্রেস, আঙ্গুরের বাগান আবহাওয়াও ছিল বৃষ্টিভেজা মনখারাপ করা পরের বছর মে মাসের দিকে আরেকটু আলো হাওয়া আসে এমন বাড়ি দেখতে বের হলেন

জুনের পাঁচ তারিখে জিনকে নিয়ে একটা বাড়ি পছন্দ করে ফেললেন বাড়িটা ভারী সুন্দর, বাড়িতে ফিরে এই ভাল খবরটা দিলেন লিভিকে লিভির শরীর কয়েকদিনে বেশ উন্নতি হয়েছিল রোদ পোহানোর জন্য মাঝে মাঝ টেরেসে বসতেন তিনি ডিনারের পর অনকখন গল্প করলেন তাঁরা তারপরে মার্ক টোয়েন পিয়ানোতে বসলেন

মার্ক টোয়েন কৃষ্ণাঙ্গদের কাছে শেখা আধ্যাত্ব সংগীত 'সুইং লো সুইট চ্যারিয়ট' বাজাচ্ছিলেন অন্য ঘর থেকে লিভি সেটা শুনতে পেয়ে পরিচারিকা ক্যাটি লিয়ারিকে বললেন 'তিনি আমাকে বিদায় সংগীত শোনাচ্ছেন '

বাজনা শেষ হলো, লিভি নিজেকে তুলে ধরতে ডাকলেন লিয়ারিকে পিয়ানো থেকে উঠে লিভির ঘরের সামনে জটলা দেখে ঘরে ঢুকলেন মার্ক টোয়েন লিভি মারা গেছেন


"At a quarter-past nine this evening she that was the life of my life passed to the relief and the peace of death, after twenty-two months of unjust and unearned suffering. I first saw her thirty-seven years ago, and now I have looked upon her face for the last time....I was full of remorse for things done and said in these thirty-four years of married life that have hurt Livy's heart."

মার্ক টোয়েনের আর ইউরোপে থাকা হলো না লিভির কফিন নিয়ে আবার এলমিরাতে ফিরে এলেন তিনি ছোট্ট ল্যাংডন আর সুজির পাশে কবর দেয়া হলো তাঁকে

 

র্ব-৩৭

নিউ ইয়র্কের ফিফ্থ অ্যাভিনিউএর ২১ নম্বরে, নাইন্থ অ্যাভিনিউএর কোনায় একটা বাসা নিলেন টোয়েন সেখানে পুরনো আসবাব পত্র সব রাখা হলো

সেই শীতে তেমন বেশি লোকজনের সাথে দেখা করেননি তিনি যা লিখেছেন সব সিরিয়াস লেখা যুদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক লেখা বের হতে লাগল টোয়েনের কলম থেকে

তবে সেগুলোর সাহিত্য-মুল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে ' হর্সেস টেল', 'ইভস ডায়েরি,' 'থ্রি থাউজ্যান্ড ইয়ার্স অ্যামাং দ্যা মাইক্রোব্স' এসবই সময়কার লেখা

মার্ক টোয়েনের সমসাময়িক সব বিদায় নিচ্ছিলেন দুনিয়া থেকে 'আমার মিছিলটা আরেকটু দূর যাবে,' লেখেন মার্ক টোয়েন ব্রেট হার্ট, চার্লস হেনরি ওয়েব, প্রথম প্রকাশক জন হে সবাই একেক করে চলে গেছেন

এমন সময়ে ১৯০৫ সালে মার্ক টোয়েনের সত্তরতম জন্মদিন চলে এল হার্পার ব্রাদার্সের প্রধান কর্নেল জর্জ হার্ভে ডেলমনিকোতে মস্ত এক পার্টির আয়োজন করলেন আমেরিকা আর ব্রিটেন থেকে 'দুই লেখক-সাংবাদিক এলেন অনুষ্ঠানে কার্নেগি, টুইচেল, ডবসন, হাওয়েল সবাই ছিলেন সেখানে রুডিয়ার্ড কিপলিং, আর্থার কোনান ডয়েল টেলিগ্রাম করলেন

সত্তরতম জন্মদিনের পার্টির এক মাসের মধ্যেই মার্ক টোয়েন আত্বজীবনী লেখার কাজে হাত দিলেন,যদিও শুরুতে তিনি শর্ত দিয়েছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর একশো বছর পর বইটা ছাপা হবে (!) সেসময়ে বেশিরভাগ সময়েই একটা রাজকীয় পালংকে শুয়ে লেখা পড়ার কাজ করতেন তিনি

বলা চলে সুতরাং সেক্রেটারি আলবার্ট বিগেলো পেইনকে দেয়া ডিক্টেশন থেকেই বইটা লেখা হয়েছিল একেবারে কোনোরকমের রেফারেন্স না দেখেই অনর্গল স্মৃতিচারণ করে গেছেন এবং সেজন্য বইটা যতটা সুখপাঠ্য হয়েছে ততটা নির্ভরযোগ্য হয়নি

তবে একটা কাজ তিনি করেননি যেটা আধিকাংশ লোক তাঁদের আত্মজীবনী লেখার সময়ে করে থাকেন সেটা হচ্ছে নিজের সাফাই গাওয়া সত্যি বলতে কী আপনি যদি মার্ক টোয়েন তাঁর সবচেয়ে খারাপ আলোকে দেখতে চান তবে আপনি এই 'মাই অটোবায়োগ্রাফি' পড়ে দেখেতে পারেন

আলবার্ট বিগেলো পেইন পরে মার্ক টোয়েনের চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ অন্যান্য কাগজ পত্র নিয়ে আরেকটি জীবনী লিখেছিলেন যেটা সত্যিকার অর্থেই ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে গ্রাহ্য করা যায় (এবং যেটা থেকে আমাদের এই মার্ক টোয়েন সিরিজ অনেকখানি নেয়া !)

সে যাইহোক সত্তরতম জন্মদিনের পরে মার্ক টোয়েন নিউ ইয়র্কের প্রধানতম দার্শনিক দ্রষ্টব্য বিষয় হয়ে উঠলেন যেখানে যত সভা সমিতি, পার্টি হবে সেখানে মার্ক টোয়েনকে দাওয়াত করা চাই না আসতে পারলে চিঠি লিখে দিতেন, সেটা পড়ে শোনানো হতো সভায়

১৯০৬ সালে রবার্ট ফুলটন সোসাইটিতে তিনি তাঁর ফেয়ারওয়েল লেকচার দিলেন মানে এটা তাঁর শেষ লেকচার যেটা মানুষ টিকেট কেটে শুনবে সান ফ্রান্সিস্কোতে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে বক্তৃতা দেবার পরে চল্লিশ বছর কেটে গেছে

মে মাসে আত্ব জীবনীর সমস্ত খসড়া নিউ হ্যাম্পশায়ারের ডাবলিনে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে মোনাডনক পাহাড়ের ঢালে আপটন হাউজের বারান্দায় বসে পান্ডুলিপি দেখতেন তিনি সামনে নিউ ইংল্যান্ডের নিসর্গ সেক্রেটারি মি. পেইন এর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে,

'
সকাল বেলায় এসেই দেখতাম (স্টেনোগ্রাফার আর আমি সেই গ্রামেই থাকতাম) আপাদমস্তক শাদা ফ্ল্যানেলের পোশাক পরে মি. ক্লিমেন্স পায়চারী করছেন বারান্দায় পিছনে নিউ ইংল্যান্ডের পর্বত, অরন্য, নদী সে অবস্থাতেই ডিক্টেশন দিতেন তিনি স্টেনোগ্রাফারকে

ঝড় বৃষ্টির সময়ে আমরা ভিতরে গিয়ে বসতাম নয়তো বাইরের দৃশ্য দেখা মিস করতাম না পারতপক্ষে কথা বলা শেষ হলে অর্কেস্ট্রেল যন্ত্রটা বাজাতে বলতেন তিনি যন্ত্রটা মেলা টাকা খরচ করে নিউ ইয়র্ক থেকে আনা হয়েছিল সাধারনত শুবার্ট, শোঁপা বা বিটোফেনের ভক্ত ছিলেন তিনি '

সামাজিকতার বিশেষ অভাব ছিল না সেখানে কিন্তু শান্তিতে কাজ করাই ছিল মার্ক টোয়েনের মুল ইচ্ছা বাড়িতে আরো ছিল তিনটা বিড়ালের বাচ্চা, বাড়িটা ভাড়া নেয়ার সময়েই তিনটে তিনি সাথে নিয়েছেন সেগুলোর নাম ছিল স্যাকক্লথ আর অ্যাশেজ 'অ্যাশেজ' আসলে দুটো বিড়াল ছানার একত্র নাম!

মার্ক টোয়েন বলেছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর একশো বছর পরে আত্ব জীবনীটা বের হবে (সেরকম হলে ২০১০ সাল পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হতো) কিন্তু মত পাল্টালেন তিনি সে বছর কয়েক চ্যাপ্টার 'দ্য নর্থ আমেরিকান রিভিউ' তে ছাপা হয়েছিল ধারাবাহিক ভাবে

যখন পুরো লেখাটার জন্য ত্রিশ হাজার ডলার অফার করা হলো সেটা ফেলতে পারলেন না টোয়েন টাকাটা দিয়ে কানেক্টিকাটের শান্ত মফস্বল শহর রেডিংএ একটা বাড়ি কেনার পিছনে খরচ করলেন বাড়ির নাম তিনি দিতে চেয়েছিলেন 'দ্যা অটোবায়োগ্রাফি হাউজ '

 

পর্ব-৩৮

বিলিয়ার্ড খেলার প্রতি আকর্ষণ মার্ক টোয়েন ছাড়তে পারেন নি পনেরো বছর আগে হার্টফোর্ডের বাড়িটা ছাড়ার পরে নিজস্ব কোনো বিলিয়ার্ড টেবিল ছিল না মার্ক টোয়েনের মিসেস হেনরি রজার্স বললেন ক্রিসমাসের সময়ে একটা বিলিয়ার্ড টেবিল উপহার দেবেন তিনি

কিন্তু মার্ক টোয়েন ছেলেমানুষের মতো দাবী করলেন টেবিলটা 'আগে' পেলে সুবিধা হয় তাঁর সুতরাং টেবিলটা মার্ক টোয়েনের বাড়িতে এসে গেল এবং আবার বিলিয়ার্ডে ডুবে গেলেন তিনি সেক্রেটারি পেইন তখন মার্ক টোয়েনের বাড়িতেই থাকতেন

আলবার্ট বিগেলো পেইন লিখেছেন,

'
সে সময়ের কথা মনে করতে গেলে আমি পরিষ্কার তিনটে জিনিস মনে করতে পারি লাল রঙের বিলিয়ার্ড রুমের মাঝখানে সবুজ বিলিয়ার্ড টেবিলটা রাখা, তার উপর কুঁজো হয়ে মার্ক টোয়েন বিলিয়ার্ডের কিউ ঠুকছেন

তারপরের দৃশ্যে দেখি আলোকিত ড্রইং রমে এককোনে নিবিষ্ট মনে অর্গান শুনছেন অর্গানের বাজনা কী ভাবনার উদয় ঘটাচ্ছে তা তিনিই জানেন আলো এসে শাদা চুলে আর শাদা পোশাকে পড়ছে শাদা ছাড়া আর কোনো রঙের পোশাক পরতেন না তিনি কালো তো নয়ই, কালো না কি মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়

তৃতীয় দৃশ্যটি হচ্ছে সেই পোশাকেই ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন তিনি '

টেবিলে প্রায়ই স্বপ্নের কথা বলতেন মার্ক টোয়েন 'প্রায় রাতেই আমি দুঃস্বপ্ন দেখি আমি মিসিসপি নদীতে ফিরে গেছি জীবিকা নির্বাহের জন্য

সেখানে একটা বিশাল ছায়াময় কালো দেয়াল দেখিয়ে আমাকে বলা হচ্ছে এটাই কী হ্যাট আইল্যান্ড বা সেলিনা ব্লাফ বা অন্য কোনো মিসিসিপি নদীর চড়া কি না ?

আরেকটা দুঃস্বপ্ন হচ্ছে, আবার দর্শনীর বিনিময়ে লেকচার দিচ্ছি আমি কিন্তু মঞ্চে উঠে দেখি গ্যালারি পুরো ফাঁকা, নয়তো আমার কোনো কথা মনে আসছে না হাসির কথা তো নয়ই তারপরে দেখি সবাই আমাকে একটা প্রায়ান্ধকার মঞ্চের মধ্যে একা ফেলে চলে গেছে '

পরের বছর আবার নিউ হ্যাম্পশায়ার গেলেন তবে উঠলেন টাক্সেডো নামে নিউ ইয়র্কের কাছের একটা শহরে আলবার্ট পেইন এই গ্রীস্মে মিসিসিপি গেলেন উদ্দেশ্য আত্ব জীবনীর জন্য তথ্য সংগ্রহ করা জনি ব্রিগস, হোরেস বিক্সবি, স্টিভ তাঁর ভাই জিমি গিলিস তখনো বেঁচে ছিলেন

ঠিক সময় মতোই পৌঁছেছিলেন তিনি হোরেস বিক্সবির বয়স একাশি বছর তখন একটা সরকারী স্টিমবোটের তদারকি করেন জনি ব্রিগস শক্ত সমর্থ আছেন কিন্তু স্টিভ গিলিস চলৎশক্তি হারিয়ে পঙ্গু তাঁরা সবাই পেইনকে নানান তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন

পশ্চিম থেকে ফিরেই পেইন দেখলেন, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় মার্ক টোয়েনকে ডক্ট অভ ডিগ্রি দেবার চিঠি দিয়েছে হ্যানিবালের সেই খালি পা, ভবঘুরে, স্কুল পালানো বালকের জন্য এক অভাবনীয় সন্মান টম সয়্যারের হাতে যাদুর কাঠি থাকলে সে এর চেয়ে বেশী কিছু করতে পারত না

১৯০৭ সালের জুন ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন তিনি চল্লিশ বছর আগে ঠীক এই দিনেই 'কোয়েকার সিটি' জাহাজে চড়ে বিদেশে যাত্রা করেছিলেন তিনি প্রায় ছয় সপ্তাহ ইংল্যান্ডে ছিলেন তিনি এবং যে খাতির যত্ন পেয়েছিলেন তিনি তা অভাবনীয় লন্ডনের সবকয়টা ক্লাব থেকে দাওয়াত এল রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড গার্ডেন পার্টিতে নিমন্ত্রণ জানালেন

র্ব-৩৯

অক্সফোর্ড শহরে হুলুস্থুল পড়ে গেল মার্ক টোয়েন কে নিয়ে শেলডোনিয়ান থিয়েটারে যখন ডিগ্রি নিতে গেলেন তখন আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের হৈ হুল্লোড়ে শোনা যাচ্ছিল না কিছু

পরদিন কাগজে লিখলো অনুষ্ঠানটা একেবারে 'সাইক্লোন' হয়েছে রুডিয়ার্ড কিপলিং থেকে শূরু করে অনেক বিখ্যাত লোকই অক্সফোর্ডে সন্মানসুচক ডিগ্রি নিয়েছেন কিন্তু কারো বেলায় এমন কান্ড ঘটে নি

তবে মার্ক টোয়েন সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন রম্য-কার্টুন পত্রিকা পাঞ্চ যখন তাঁকে ডিনারে ডাকল তখন পাঞ্চ ইতিমধ্যেই প্রথম পৃষ্ঠায় একটা কার্টুন দিয়ে মার্ক টোয়েনকে সন্মানিত করেছিল

পাঞ্চের স্টাফরা এর আগে কোনো বিদেশী লেখককে ডিনারে ইনভাইট করেনি অক্সফোর্ডের ডিগ্রি ইংল্যান্ডে সংবর্ধনা মার্ক টোয়েনের দীর্ঘ জীবনের সবচেয়ে বড় সন্মানগুলোর একটা পরের বছর হেনরি রজার্সের সাথে বারমুডাতে কাটালেন তিনি

ওদিকে কানেক্টিকাটের রেডিংএ নতুন বাড়ি 'স্টর্মফিল্ড' তৈরী হচ্ছিল বছরখানেক ধরে আশ্চর্যের ব্যাপার এই বাড়ি দেখা দূরে থাক, বাড়ির নকশাও দেখেননি তিনি 'যখন বাড়িটা তৈরী হবে, ফায়ার প্লেসের সামনে বিড়াল শুয়ে থাকবে আমি তখন বাড়িটা যতখুশি দেখতে পাবো' এই ছিল তাঁর যুক্তি

হতে পারে লিভির আর সুজির মৃত্যু তাঁকে বাড়ির ব্যাপারে এরকম উদাসীণ করে তুলেছিল তবে নির্দেশ দেয়া ছিল, বাড়ির ঘরগুলো যেন বড় বড় হয় আর বিলিয়ার্ড রুমের রঙ যেন লাল হয়

১৮ই জুন ১৯০৮ সালে বাড়ি বুঝে পেলেন তিনি তবে ফিফথ অ্যাভিনিউএর বাড়িটা খালি করা হয় নি স্টর্মফিল্ডকে মফস্বলের অবকাশ কাটানোর জায়গা হিসেবেই ভাবছিলেন মার্ক টোয়েন

ছটার সময়ে ঘুম থেকে উঠে দাড়ি কামিয়ে রেডিংএর উদ্দ্যেশ্যে ট্রেনে চাপলেন টোয়েন স্টেশনে দেখা গেল বেশ কিছূ রিপোর্টার জমায়েত হয়েছে মার্ক টোয়েনের গৃহ প্রবেশ দেখতে পকেট থেকে পয়সাভর্তি হাত বের করে সাথের লোকদের বললেন স্টেশনের পোর্টারদের দিতে

স্টেশন থেকে তিন মাইল ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে গেলেন তিনি পথের দুপাশে ডেইজি আর ডগউড ফুটে ছিল তখন পাহাড়ের ঢালগুলো ছিল সবুজ গভীর চিন্তাম্বিত ভাবে মার্ক টোয়েন দেখছিলেন দুপাশের দৃশ্য বয়ে চলা ঝর্ণা, আর নিউ ইংল্যান্ডের শাদা রঙ করা ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে চলছিলেন তাঁরা

অবশেষে বাড়িটার এসে পৌঁছালেন তাঁরা ইটালিয়ান ধাঁচের ভিলা, ফ্লোরেন্সের বাড়িটার আদলে তৈরি করা এবং সতেরো বছর পর নিজস্ব বাড়িতে পা দিলেন তিনি আবার বাড়িটা ঘুরে ফিরে খোলা একটা ফ্রেঞ্চ উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকালেন তিনি নীল আকাশ আর খামারবাড়ির ছাদগুলো দেখা যাচ্ছিলো জানালা দিয়ে

র্ব-৪০

সেদিন সন্ধ্যায় অনেক অতিথি এসেছিলেন মার্ক টোয়েনকে স্বাগত জানাতে সেক্রেটারি মি. পেইন মার্ক টোয়েনের সাথেই থাকতেন ডিনার শেষে বাগানে আতশবাজি পোড়ানো হলো মার্ক টোয়েনের প্রতিবেশী, ড্যান বিয়ার্ড বাজিতে আগুন ধরালেন তারপরে অনেক রাত পর্যন্ত বিলিয়ার্ড খেলা চলল

নতুন বাড়িতে মার্ক টোয়েনের প্রথম দিনটা আনন্দেই কেটেছে বলা যায়

খুব শিগগিরই স্টর্মফিল্ডের মায়ায় পড়ে গেলেন টোয়েন, আর নিউ ইয়র্কের পাট চুকিয়ে এখানেই স্থায়ীভআবে আড্ডা গাড়লেন বিশেষ অনুরোধ করলেই তবে নিউ ইয়র্কের কোনো ফাংশনে যেতেন তিনি শেষ পর্যন্ত আর অনুরোধেও ঢেঁকি গেলাতে আজি করা গেল না তাঁকে বাড়িতেই যথেষ্ট বন্ধুবান্ধবের সমাগম ঘটত

বিলিয়ার্ড রুমটাকে তিনি বলতেন 'অ্যাকুরিয়াম,' দেয়াল জুড়ে নানান মাছের মোটিফ ছিল সমস্ত অল্পবয়সী মেয়েরা একটা মাছকে 'নিজের' বলে বেছে সেখানে তাদের নাম লিখতে পারত ফলে তারা 'অ্যাকুরিয়াম ক্লাবের' সদস্য হয়েছে বলে ধরে নেয়া হতো

তবে বাড়িটার আসল মালিক ছিল বিড়ালরা এমন কী বিলিয়ার্ড খেলার সময়েও এক আধটা বিড়ালের বাচ্চা টেবিলের উপর বলের পিছনে ছুটত! কিন্তু সেগুলোকে না সরিয়ে অন্য অ্যাঙ্গলে শট নিতে হত খেলোয়ারদের

মার্ক টোয়েনের সচিব মি. আলবার্ট পেইন তখন মাইল খানেক দুরের একটা বাড়িতে থাকতেন কাজ ছাড়াও বিলিয়ার্ড খেলা গল্প গুজবের জন্য তিনি আসতেন এলাকায় একজন স্টেনোগ্রাফারও ছিল ডিক্টেশন নেয়ার জন্য, যদিও খুব বেশি ডিক্টেশন দিতেন না তিনি অল্প-স্বল্প লেখালেখিও করছিলেন তিনি 'ইজ শেক্সপিয়ার ডেড?' এসময়ই লেখা

তারপরে শীতকালে মি. পেইন ইউরোপ ভুমধ্যসাগর অঞ্চলে গেলেন ফিরে এসে দেখলেন মার্ক টোয়েনের মেয়ে জিন উঠেছে বাবার বাসায় এবং টোয়েনের স্বাস্থ্যেও সামান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন তিনি

ডাক্তাররা ধুমপান কমাতে বা একদম না করতে পরামর্শ দিচ্ছিলেন খুব তাড়াহুড়ো করে সিঁড়িভাঙ্গার অভ্যাসটাও তাঁরা ছাড়তে বলছিলেন বুকের ব্যাথা বা অ্যানজাইনা পেক্টোরিসে ভুগছিলেন টোয়েন যেটা বুকের পেশীতে অক্সিজেনের অভাব হলে হয়ে থাকে

মার্ক টোয়েনের জমির একটা নির্জন সেডার গাছে ঘেরা অংশে আলবার্ট পেইন একটা পড়ার ঘর বানালেন, যার নাম দেয়া হলো 'মার্কল্যান্ড' সেখানে আরেকটা বিলিয়ার্ড টেবিল (এটা হেনরি রজার্সের দেয়া, নিউ ইয়র্কে পড়েছিল এতদিন) নিয়ে আসা হলো সেখানে দুজনে জন্ম-মৃত্যু-সৃষ্টি সমস্ত ব্যাপারে আলাপ করতেন

জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতে ভাল বাসতেন তিনি সুর্যের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র পঁচিশ ট্রিলিয়ন মাইল দূরে আছে এই তথ্যটা শুনে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন পাতার পর পাতা নানান জ্যোতিরবৈজ্ঞানিক তথ্যে ভরিয়ে ফেলতেন তিনি

ধুমকেতু আকর্ষণ করত তাঁকে এবং একদিন বলে ফেললেন 'আমি হ্যালির ধুমকেতুর সাথে এসেছি, এবং হ্যালির ধুমকেতুর সাথেই যেতে পারলে খুব ভাল হয় (!)'

র্ব-৪১

সে বছরই মার্ক টোয়েনের মেজো মেয়ে ক্লারা ক্লিমেন্স, রুশ পিয়ানোবাদক ওসিপ গাভ্রিলোভিচকে বিয়ে করে ইউরোপে পাড়ি জমান

সুতরাং বাবাকে দেখার সমস্ত ভার এসে পড়ল জিন ক্লিমেন্সের উপর জিন পুরো সুস্থ ছিলেন না, ক্যাটালেপ্সির (মৃগী রোগ) ধরন ছিল তাঁর মি. পেইনের অবর্তমানে বাবার সচিবের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি বাইরে থেকে তাঁর অসুখটা খুব সিরিয়াস মনে হতো না

১৯০৯ সালের নভেম্বর মাসে বারমুডা যাবার শখ হলো টোয়েনের সেসময়ে ঠান্ডা আর টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ে নিউ ইংল্যান্ডে সেখান থেকে ফিরে নতুন দুঃসংবাদ শুনতে হলো টোয়েনকে

আসলে ক্রিসমাসের সময়ে খুব কাজের চাপ পড়েছিল জিনের সবার জন্য উপহার (কারোটা যেন বাদ না যায়) কিনতে ছোটাছুটি করতে হচ্ছিল শহরে

বাড়ির সামনে মস্ত একটা ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়েছিলেন তিনি এইসব করতে গিয়ে ঠান্ডা লেগে গিয়েছিল তাঁর ২৪ তারিখে ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে গিয়ে শকে মারা যান তিনি

নীচের গাড়িবারান্দার সামনে বরফ ঢাকা, রাংতা মোড়ানো গাছটা দাঁড়িয়েছিল সবার জন্য কেনা উপহার নিয়ে মা আর ভাইয়ের পাশে জিনকে কবর দেয়ার জন্য এলমিরাতে নিয়ে যাওয়া হলো জিনের এক কাজিন জার্ভিস ল্যাংডন এলো মার্ক টোয়েনের বাড়িতে থাকার জন্য

সময়টা ছিল সন্ধ্যা ছটা ঝিরঝির করে নরম তুষার পড়ছিল আকাশ থেকে, শীতের সংক্ষিপ্ত দিনের আলো মরে এসেছিল সেসময়ই সব কিছু নিঃসাড়, নিঃশব্দ; পুরো পৃথিবী ঢাকা পড়েছিল বরফের চাদরের তলায়

সদর দরজার পাশে একটা লন্ঠন জ্বলছি উপরের তলার একটা জানালায় দাঁড়িয়ে মার্ক টোয়েন জীবনের শেষ পার্থিব ঠিকানা থেকে তাঁর মধ্যমা কন্যার চলে যাওয়া দেখছিলেন

"From my window I saw the hearse and the carriages wind along the road and gradually grow vague and spectral in the falling snow, and presently disappear. Jean was gone out of my life, and would not come back any more. The cousin she had played with when they were babies together--he and her beloved old Katy--were conducting her to her distant childhood home, where she will lie by her mother's side once more, in the company of Susy and Langdon."

র্ব-৪২

দুঃখ ভোলার জন্য দিন পরে মাত্র একজন সংগীকে নিয়ে বারমুডা চলে এলেন মার্ক টোয়েন পেইনকে বললেন স্টর্মফিল্ডের বাড়িটা তৈরি রাখতে , যে কোনো সময়ে ফিরতে পারেন তিনি, তারপরে পেইনকে বারমুডাতে আসতে বললেন তিনি সেখানে কোনো হোটেলে না উঠে কনসাল অ্যালেনের বাড়িতে উঠেছিলে তিনি

বারমুডায় থেকে অনেক শরীর মন দুদিক থেকেই উন্নতি হলো মার্ক টোয়েনের প্রায় রোজই চিঠি লিখছিলেন তিনি, তবে আর হাতে লিখছিলেন না সেসময়কার চিঠিগুলো মি. অ্যালেনের মেয়ে হেলেনের হাতের লেখা সময়কার চিঠিগুলোতে বুকের ব্যাথার কোনো উল্লেখ নেই ১৯১০ সালের মার্চ মাসে তিনি আলবার্ট পেইনকে লিখলেন যে তিনি ভাল হয়ে উঠছেন এবং জায়গায় "মরার কোনো ইচ্ছা নেই তাঁর"

কিন্তু এক সপ্তাহ পরে মি. অ্যালেন নিজেই চিঠি লিখে মি. পেইনকে বললেন টোয়েন গুরুতর অসুস্থ জিন ওসিপকে টেলিগ্রাম করে নিউ ইয়র্ক থেকে বারমুডার উদ্দেশ্যে পরদিন জাহাজে চাপলেন পেইন কিন্তু বারমুডায় কিছু লিখলেন না পেইন পেইন দেখে খুব অবাক হলেন টোয়েন

হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন 'তুমি আসবে লেখো নি তো?'

'
আপনার গত কয়েকটা চিঠি পড়ে চিন্তায় পড়ে গেছিলাম '

'
আমি তো বলেছি আমার কিছু হয় নি '

সে যাহোক পেইনকে দেখে আসলে খুশিই হয়েছিলেন মার্ক টোয়েন ওজন কমে গিয়ে চোখ জ্বলজ্বল করছিল তাঁর নানান ইঞ্জেকশন দেয়া হচ্ছিল টোয়েন কে যেহেতু আগে কখনো ইঞ্জেকশন নেননি, খুব অভিনব অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর 'হাইপোডার্মিক' আর 'সাবকিউটেনিয়াস' ইঞ্জেকশানের পার্থক্য পেইনকে খুব জমিয়ে বললেন তিনি তবে মি. মিসেস অ্যালেনের কাছ থেকে পেইন শুনলেন খুব অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন টোয়েন আসলে ইঞ্জেকশানগুলো বেদনানাশক ছাড়া আর কিছু ছিল না

আলবার্ট পেইনের সাথে বিকালে বেড়াতে বের হলেন তিনি অসুখের কোনো চিহ্নই দেখা গেল ক্লিমেন্সের আচরণে জিনের একটা খামার ছিল, সেটা বেচে 'হাজার ডলার পেয়েছেন পেইন রেডিংএ ইতিমধ্যেই একটা লাইব্রেরি খুলতে সাহায্য করেছেন টোয়েন, পেইনকে সেখানেই এই টাকা খরচ করতে বললেন তিনি

কিন্তু আবার বুকের ব্যাথাটা ফিরে এল কয় দিন পরে তারপরেও ১২ তারিখে দেশে ফেরার জন্য জাহাজে চাপলেন টোয়েন জাহাজে আবার এতোটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন টোয়েন যে প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পারবেন কি না সন্দেহ দেখা দিয়েছিল কিন্তু সেসময়ে স্বভাবসুলভ রসিকতা ছাড়েননি তিনি একবার তিনি আলবার্ট পেইনকে বলে ছিলেন,

'
আমি খুব দুঃখিত পেইন, আমি চেষ্টা করেও তাড়াতাড়ি মরতে পারছি না '

'
বুঝলে আলবার্ট, খুব রহস্যজনক এই মৃত্যু ব্যাপারটা '

ডাক্তার, আত্বীয়স্বজন, রিপোর্টার সবাই ডকে ভীড় করেছিল মার্ক টোয়েনের জন্য ঠান্ডা আবহাওয়াতে কিছুটা সুস্থ বোধ করে কয়েকঘন্টা ঘুমালেন তিনি রেডিংএ যাওয়ার জন্য একটা বিশেষ ট্রেনের কামরা ভাড়া করা হলো চিকিৎসক পরিবৃত হয়ে রেডিংএ পৌঁছালেন তিনি ট্রেনে বা ঘোড়ার গাড়িতে চড়তে বিশেষ অসুবিধা হলো না টোয়েনের বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে আলবার্ট পেইনকে জিগ্যেস করলেন,

'
আমার নতুন বিলিয়ার্ড রুমটা কোথায় বানিয়েছ?'

গাছের ফাঁক দিয়ে দূরে নতুন বানানো স্টাডির একটা অংশ দেখা যাচ্ছিল, দেখানো হলো তাঁকে

'
সুন্দর হয়েছে,' মন্তব্য করলেন টোয়েন

বাড়িতে এসে কারো সাহায্য সাহায্য ছাড়াই গাড়ি থেকে নামলেন টোয়েন সেখানে বাড়ির সব কাজের লোকের সাথে হাত মেলালেন সবার সাথে তারপরে একটা ক্যানভাসের চেয়ারে বসিয়ে ধরাধরি করে দোতলায় নিজের কামরায় নিয়ে যাওয়া হলো তাঁকে সেখানে জানালা দিয়ে সুর্যাস্তের আলোতে ধোয়া দূরের পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল

দিনটা ছিল ১৪ এপ্রিল, বৃহষ্পতিবার, ১৯১০ সাল

******

পরের সপ্তাহে কখনো ভাল, কখনো খারাপ হতে লাগল টোয়েনের অবস্থা সুস্থ থাকার সময়ে কার্লাইল আর সুটেনিয়াস পড়েছেন তিনি রবিবারে মেয়ে-জামাই, ক্লারা আর ওসিপ গাভ্রিলোভিচ হন্ত দন্ত হয়ে এলো প্যারিস থেকে মার্ক টোয়েনকে সুস্থই মনে হয়েছিল তখন কিন্তু বুধবার থেকে আবার শরীর খারাপ হতে শুরু করল তাঁর

ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পারে, কিন্তু বুধবার, ২০ এপ্রিল, ১৯১০ সালে উত্তর গোলার্ধের আকাশে হ্যালির ধুমকেতু প্রথম দেখা গিয়েছিল !

পরদিন একটু সুস্থ হলে মার্ক টোয়েন পেইনকে বললেন দুটো অসমাপ্ত পান্ডুলিপি "ছুঁড়ে" ফেলে দিতে পেইন বললেন সেটা তিনি করবেন, সেক্রেটারির হাত চেপে ধরলেন মার্ক টোয়েন, এবং সেটাই পৃথিবীতে তাঁর শেষ কথা বিকেলের দিকে গভীর ঘুমে ঢলে পড়লেন তিনি, এবং সে ঘুম আর কখনো ভাঙ্গবে না সাড়ে 'টার দিকে, সুর্যাস্তের সময় . কুইন্টার্ড দেখলেন মার্ক টোয়েনের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমশঃ শ্লথ হয়ে আসছে.....

কিছুক্ষণ পরে মাথাটা একদিকে কাত হয়ে গেল এবং স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্স / মার্ক টোয়েন তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন
 



নিউ ইয়র্কের ব্রিক চার্চে শেষকৃত্যের পর পরদিন এলমিরাতে নিয়ে যাওয়া হলো মার্ক টোয়েনের অবশেষ ল্যাংডন, লিভি, সুজি, জিনের পাশে আরেকটা কবর খোঁড়া হলো, স্যাম ক্লিমেন্সের জন্য

মিসিসিপি নদীর তীরে দাপিয়ে বেড়ানো হ্যানিবালের সেই ভবঘুরে বালক, মাটির পৃথিবীতে; তাঁর শেষ ঠিকানায় পৌঁছে গেছেন
 


****** সমাপ্ত *****

 

থ্যসূত্র

Mark Twain and River (Sterling North, 1962)

The Boy's Life of Mark Twain ( Albert Bigellow Paine, 1924),

Roughing It (Mark Twain)

A Burlesque Autobiography (Mark Twain)

এবং বিস্তর ওয়েবসাইট !

 

 

 

 

 পর্ব (১-১০)

পর্ব (১-০)

পর্ব (২১-৩০)